বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আজ বিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। তাই আজকের এই আলোচনায় আমরা জানব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির গোপন রহস্য।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত দশকে ব্যাপক গতি পেয়েছে। দেশটি ধারাবাহিকভাবে ৬ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এই হার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এই প্রবৃদ্ধি টেকসই। কারণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু একটি খাতের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত সমানভাবে অবদান রাখছে।
তবে এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দক্ষ জনশক্তি। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের সঠিক নীতিমালা। ফলে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ জিডিপি র্যাংকিং
বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ জিডিপি র্যাংকিং ক্রমাগত উন্নতি করছে। বর্তমানে দেশটি বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। এই অবস্থান অর্জন করতে বাংলাদেশের লেগেছে মাত্র কয়েক দশক।
২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। অথচ ১৯৭১ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। এই বৃদ্ধি সত্যিই অবিশ্বাস্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ শীঘ্রই বিশ্বের ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এটি দেশের জন্য গর্বের বিষয়।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারত ও পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
বাংলাদেশের জিডিপি ইতিহাস
বাংলাদেশের জিডিপি ইতিহাস অত্যন্ত চমকপ্রদ। ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরুর পর দেশটির অর্থনীতি পরিবর্তনের নানা পর্যায় পার করেছে। প্রথম দিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল খুবই কম।
১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন মাত্রা পায়। তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। পাশাপাশি কৃষি খাতেও আধুনিকায়ন ঘটে।
১৯৯০ এর দশক থেকে প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়। বিশেষত ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করে।
২০০৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ। এই হার বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৮২ শতাংশ। যদিও কোভিড-১৯ এর প্রভাবে এই হার কিছুটা কমেছিল।
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৫ শতাংশ। এই হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন আগামী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার আবার ৭ শতাংশের উপরে উঠবে। কারণ দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে।
তাছাড়া সরকারি খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত ভোগ বৃদ্ধির কারণেও প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। সুতরাং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৫
বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন মাইলফলক অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭.৫ শতাংশ। এই লক্ষ্য অর্জন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মেগা প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং এবং আইটি খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। ফলে এই খাতগুলো ২০২৫ সালে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
তাছাড়া রপ্তানি বহুমুখীকরণের ফলে বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানির তালিকায় যোগ হওয়ায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও মজবুত হবে।
কৃষি খাতের অবদান জিডিপিতে
কৃষি খাতের অবদান জিডিপিতে এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও সময়ের সাথে এর অনুপাত কমেছে, তবুও দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১১.৫ শতাংশ।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান, গম, ভুট্টা, আলু উৎপাদনে দেশ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই সফলতার পেছনে রয়েছে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সরকারি সহায়তা।
মৎস্য চাষ এবং পোল্ট্রি শিল্পেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এসব উপখাত কৃষি খাতের অবদান বৃদ্ধি করেছে।
তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা আরও বাড়ানো সম্ভব। জৈব চাষাবাদ এবং স্মার্ট ফার্মিংয়ের দিকে মনোযোগ দিলে কৃষি খাতের অবদান আরও বাড়বে। পাশাপাশি কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিকাশের সুযোগ রয়েছে।
শিল্প খাতের অবদান জিডিপিতে
শিল্প খাতের অবদান জিডিপিতে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশ। তৈরি পোশাক শিল্প এই খাতের প্রধান চালিকাশক্তি। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, প্লাস্টিক, ইস্পাত শিল্পেও দেশ অগ্রগতি করছে। এসব শিল্প দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পে বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন বিদেশেও ওষুধ রপ্তানি করছে। এই খাতে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে শিল্প খাতের আরও বিকাশের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে নতুন শিল্প স্থাপন করা যাবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প স্থাপনেও মনোযোগ দিতে হবে। ভারী শিল্প এবং রাসায়নিক শিল্পের বিকাশও জরুরি।
সেবা খাতের অবদান জিডিপিতে
সেবা খাতের অবদান জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে এই খাতের অবদান প্রায় ৫৩.৫ শতাংশ। ব্যাংকিং, বীমা, পরিবহন, যোগাযোগ, খুচরা ব্যবসায় এই খাতের অন্তর্ভুক্ত।
মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবা এই খাতে বিপ্লব এনেছে। বিকাশ, নগদের মতো সেবাগুলো গ্রামীণ অর্থনীতিকে মূলধারার সাথে যুক্ত করেছে।
পর্যটন শিল্প সেবা খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কক্সবাজার, সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে এই খাতের আরও উন্নয়ন দরকার।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতেও উন্নতি হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং ক্লিনিক সেবার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে সেবা খাতের আরও বিকাশের সুযোগ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি, কল সেন্টার, আউটসোর্সিং এই খাতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ একাধিক। অবকাঠামোর অভাব এখনও একটি বড় বাধা। যদিও সরকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তবুও পর্যাপ্ত রাস্তা, বিদ্যুৎ, বন্দর সুবিধা এখনও নেই।
দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে আরও কাজ করতে হবে। নীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে হবে।
দক্ষ জনশক্তির অভাব আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাব্যবস্থা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন করা জরুরি। যুব সমাজকে বিভিন্ন দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করতে হবে।
পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় এলাকার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামী দশকে দেশটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা বাংলাদেশের পক্ষে। তরুণ জনগোষ্ঠীর বড় অংশ কর্মক্ষম। এই জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ব্লকচেইন প্রযুক্তি নতুন শিল্প গড়ে তুলতে পারে।
অবশ্য এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা দরকার। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, দক্ষতা উন্নয়ন, গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।
বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও জিডিপি
বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩.৮৮ বিলিয়ন ডলার।
চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ করছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। এসব অঞ্চলে নতুন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে।
তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। এসব বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে ভূমিকা রাখছে।
অবশ্য বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে আরও কাজ করতে হবে। নীতিগত স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, দুর্নীতি দমন জরুরি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। তবু আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
রেমিট্যান্সের প্রভাব জিডিপিতে
রেমিট্যান্সের প্রভাব জিডিপিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ছিল ২৩.৯ বিলিয়ন ডলার।
এই অর্থ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রবাসী আয়ে পরিবারগুলো ভোগ বৃদ্ধি করে।
আবাসন খাতে রেমিট্যান্সের বিনিয়োগ ব্যাপক। প্রবাসীরা বাড়িঘর নির্মাণ করেন। এতে নির্মাণ শিল্প সমৃদ্ধ হয়। পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ও চাঙ্গা হয়।
তবে রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে অস্থিরতা রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর এর প্রবাহ নির্ভর করে। কোভিড-১৯ এর সময় রেমিট্যান্স কমে গিয়েছিল। নতুন কর্মসংস্থানের বাজার খুঁজে প্রবাসী পাঠানোর নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। দক্ষ জনশক্তি প্রেরণে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুমাত্রিক। দারিদ্র্য হ্রাস এই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ১৯৯১ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬.৬ শতাংশ। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশে।
মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অগ্রগতি হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য।
গ্রামীণ উন্নয়নে মাইক্রো ক্রেডিট কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ড. মুহাম্মদ যুনূসের গ্রামীণ ব্যাংক মডেল বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। এই কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়নেও ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। এসব প্রকল্প দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি তুলনা
দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। ভারত এবং পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তবে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১,৫৬৮ ডলার। এই সাফল্য বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
প্রবৃদ্ধির হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে। গত দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৮ শতাংশ। এই হার দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি।
শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের তুলনায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সফল।
আফগানিস্তান এবং ভুটানের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট। তবে মালদ্বীপের মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। পর্যটন শিল্পের কারণে মালদ্বীপের আয় বেশি।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, এই প্রবৃদ্ধি শুধু একটি খাতের উপর নির্ভরশীল নয়। কৃষি, শিল্প ও সেবা তিন খাতই সমানভাবে অবদান রাখছে।
দ্বিতীয়ত, দেশীয় চাহিদা প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ভোগ বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগও প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
তৃতীয়ত, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। এতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ হচ্ছে।
চতুর্থত, রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনেছে। প্রবাসী আয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করেছে। এতে আমদানি সক্ষমতা বেড়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আজ বিশ্বের কাছে এক অনুকরণীয় উদাহরণ। স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ দশকে দেশটি দারিদ্র্য থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সঠিক নীতিমালা, দক্ষ জনশক্তি এবং উদ্যোক্তা মনোভাব।
তবে এই অর্জনের উপর ভর করে বসে থাকার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে। বিশেষত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলে চলবে না।
অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, গবেষণায় বিনিয়োগ, পরিবেশ সংরক্ষণ এসব বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করতে পারবে। জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস এবং সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই পারে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শুধু সংখ্যার হিসাব নয়। এটি কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের গল্প। প্রতিটি শতাংশ প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী(FAQs)
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত?
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫.৮২ শতাংশ। তবে গত দশকের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৮ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন আগামী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি আবার ৭ শতাংশের উপরে উঠবে।
বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান কত?
বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। জিডিপির আকার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী শীঘ্রই বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের জিডিপিতে কোন খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি?
বাংলাদেশের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫ৣ.৫ শতাংশ। শিল্প খাতের অবদান ৩৫ শতাংশ এবং কৃষি খাতের অবদান ১১.৫ শতাংশ। সময়ের সাথে সেবা ও শিল্প খাতের অবদান বাড়ছে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কত?
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার। এই আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান চালিকাশক্তি কী?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প, রেমিট্যান্স, কৃষি এবং সেবা খাত। এছাড়া দেশীয় চাহিদা বৃদ্ধি এবং সরকারি বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতও দ্রুত বিকশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা কী?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধাগুলো হলো: অবকাঠামোর অভাব, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে পারবে কি?
সরকারের রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করবে। এজন্য ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। বর্তমান অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
কোভিড-১৯ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছে?
কোভিড-১৯ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে দ্রুত পুনরুদ্ধারের ফলে পরবর্তী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি উদ্দীপনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কেমন?
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক এই আয়ের ৮৫ শতাংশ। তবে চামড়া, জুতা, ওষুধ, কৃষিপণ্য রপ্তানিও বাড়ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান কেমন?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই নারী। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং খাতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। মাইক্রো ক্রেডিট কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন।
🔥 পোস্টটি শেয়ার করুনঃ 🌍